বর্তমান সময়ে ফেসবুক শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়—এটি আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি, ভিডিও, ব্যবসা, পেজ এবং পরিচয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাই একাউন্ট হ্যাক হয়ে গেলে শুধু তথ্য হারানো নয়, আর্থিক ক্ষতি এবং সম্মানহানিও হতে পারে। অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন অসতর্কতার কারণে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। তাই এখন সময় সচেতন হয়ে অ্যাকাউন্ট সুরক্ষিত করার।
১. শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন
ফেসবুক হ্যাকিংয়ের সবচেয়ে সহজ উপায় হলো দুর্বল পাসওয়ার্ড অনুমান করা। তাই দুর্বল পাসওয়ার্ড ব্যবহার মানেই নিজেই ঝুঁকিতে ফেলা।
➡ করণীয়:
- কমপক্ষে ১২–১৬ অক্ষরের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন।
- বড় হাতের অক্ষর, ছোট হাতের অক্ষর, সংখ্যা ও বিশেষ চিহ্ন মিশিয়ে বানান।
- নিজের নাম, জন্মতারিখ, মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করবেন না।
- প্রতিটি ওয়েবসাইট বা অ্যাপের জন্য আলাদা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন।
- চাইলে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার (যেমন: Bitwarden, LastPass) ব্যবহার করতে পারেন।
👉 মনে রাখবেন: পাসওয়ার্ড যত শক্তিশালী হবে, হ্যাকারদের জন্য ভাঙা তত কঠিন হবে।
২. দুই ধাপ যাচাইকরণ (Two-Factor Authentication) চালু করুন
শুধু পাসওয়ার্ড থাকলেই যথেষ্ট নয়। হ্যাকার পাসওয়ার্ড পেলেও দুই ধাপ যাচাইকরণ থাকলে অ্যাকাউন্টে ঢুকতে পারবে না।
➡ করণীয়:
- Settings → Security and Login → Two-Factor Authentication এ যান।
- SMS কোডের বদলে Authenticator App (Google Authenticator বা Authy) ব্যবহার করুন।
- Backup Codes ডাউনলোড করে সুরক্ষিত স্থানে সংরক্ষণ করুন।
👉 2FA অন থাকলে অ্যাকাউন্ট হ্যাক হওয়ার ঝুঁকি ৯০% কমে যায়।
৩. লগইন এলার্ট চালু করুন
অচেনা ডিভাইস বা লোকেশন থেকে কেউ লগইন করলে সঙ্গে সঙ্গে নোটিফিকেশন পাবেন। এতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
➡ করণীয়:
- Security and Login → Get alerts about unrecognized logins চালু করুন।
- ইমেইল এবং নোটিফিকেশন উভয় মাধ্যমেই এলার্ট নিন।
৪. ডিভাইস ম্যানেজমেন্ট করুন
অনেক সময় আমরা বিভিন্ন জায়গায় ফেসবুক খুলি এবং পরে লগআউট করতে ভুলে যাই। এটি বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে।
➡ করণীয়:
- Settings → Security and Login → Where you’re logged in এ যান।
- অচেনা সব ডিভাইস থেকে লগআউট করুন।
- ক্যাফে বা অন্য কারও ফোনে লগইন করলে কাজ শেষে অবশ্যই Sign Out করুন।
৫. ফিশিং লিংক ও ভুয়া ওয়েবসাইট থেকে সতর্ক থাকুন
হ্যাকাররা অনেক সময় ভুয়া ওয়েবসাইট বানিয়ে আপনাকে লগইন করাতে চায়। একবার লগইন করলে আপনার ইউজারনেম-পাসওয়ার্ড তাদের হাতে চলে যায়।
➡ করণীয়:
- অপরিচিত লিংকে ক্লিক করবেন না।
- সবসময় ব্রাউজারের অ্যাড্রেসবারে ঠিকানা (facebook.com) মিলিয়ে নিন।
- ফেসবুক কখনো ইমেইল বা মেসেজে আপনার পাসওয়ার্ড চাইবে না।
- সন্দেহ হলে সরাসরি অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে গিয়ে লগইন করুন।
৬. প্রাইভেসি সেটিংস আপডেট করুন
যদি প্রাইভেসি ঠিক না করা হয়, তবে অপরিচিতরা সহজেই আপনার তথ্য, ছবি এবং পোস্ট ব্যবহার করতে পারে।
➡ করণীয়:
- Who can see your future posts → Friends অথবা Only Me করুন।
- Friend Requests → Friends of Friends সিলেক্ট করুন।
- Timeline & Tagging → Tag Review অন করুন।
- কে আপনার ইমেইল বা ফোন নাম্বার দিয়ে আপনাকে খুঁজে পাবে, সেটি Friends বা Only Me করুন।
৭. অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ/ওয়েবসাইট সরান
অনেক সময় ফ্রি গেম, কুইজ বা তৃতীয় পক্ষের অ্যাপ আপনার অ্যাকাউন্টে প্রবেশাধিকার চায়। এগুলো হ্যাকিংয়ের অন্যতম পথ।
➡ করণীয়:
- Settings → Apps and Websites এ যান।
- অচেনা বা অব্যবহৃত সব অ্যাপ রিমুভ করুন।
- প্রয়োজন ছাড়া কোনো থার্ড-পার্টি অ্যাপকে এক্সেস দেবেন না।
৮. Trusted Contacts যুক্ত করুন
কখনো কখনো একাউন্ট লক হয়ে যেতে পারে। তখন Trusted Contacts কাজে লাগবে।
➡ করণীয়:
- Security and Login → Choose friends to contact if you get locked out এ গিয়ে ৩–৫ জন বিশ্বস্ত বন্ধু অ্যাড করুন।
- তারা কোড দিয়ে আপনাকে একাউন্ট ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারবে।
৯. নিয়মিত সিকিউরিটি রিভিউ করুন
একবার সেটিংস করে ভুলে গেলে চলবে না। সময় সময় রিভিউ করতে হবে।
➡ করণীয়:
- প্রতি ৩–৪ মাস পরপর পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করুন।
- অচেনা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এড়িয়ে চলুন।
- Security Checkup অপশন ব্যবহার করে নিরাপত্তা পরীক্ষা করুন।
১০. বাড়তি টিপস
- পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহার করে লগইন করবেন না।
- ব্রাউজারে Save Password বন্ধ রাখুন।
- ব্যক্তিগত তথ্য (জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংক তথ্য, OTP) কারও সঙ্গে শেয়ার করবেন না।
- পেজ/গ্রুপে একাধিক অ্যাডমিন থাকলে সবাইকে 2FA ব্যবহার বাধ্যতামূলক করুন।
- ব্যবসার জন্য আলাদা ইমেইল ব্যবহার করুন এবং তা সুরক্ষিত রাখুন।
১১. যদি হ্যাক হয়ে যায়?
অ্যাকাউন্ট হ্যাক হলে আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
➡ করণীয়:
- facebook.com/hacked এ যান।
- তৎক্ষণাৎ পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করুন এবং সব ডিভাইস থেকে লগআউট দিন।
- ইমেইল অ্যাকাউন্টও সুরক্ষিত করুন।
- ফেসবুক সাপোর্ট সেন্টারে যোগাযোগ করুন।
উপসংহার
ফেসবুক হ্যাকিং প্রতিদিন নতুন কৌশলে আমাদের সামনে আসছে। হ্যাকিং বা প্রতারণার শিকার হওয়া মানেই শুধু অ্যাকাউন্ট হারানো নয়—বরং ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস, আর্থিক ক্ষতি এবং মানহানির ঝুঁকি তৈরি হয়। তবে সচেতন থাকলে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়।
- শক্তিশালী ও ইউনিক পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন।
- 2FA চালু রাখুন।
- প্রাইভেসি সেটিংস টাইট করুন।
- অচেনা লিংক ও অ্যাপ এড়িয়ে চলুন।
- নিয়মিত সিকিউরিটি রিভিউ করুন।
👉 মনে রাখবেন: আপনার নিরাপত্তা আপনার নিজের হাতেই। সচেতনতা ও সতর্কতাই সবচেয়ে বড় সুরক্ষা।