ইন্টারনেট আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করেছে। বাজার করা থেকে শুরু করে ব্যাংক লেনদেন, পড়াশোনা, চাকরি খোঁজা, বিনোদন—সবকিছুই এখন কয়েক ক্লিকের মধ্যে পাওয়া যায়। তবে এর পাশাপাশি বেড়েছে প্রতারণার ঝুঁকি। প্রতারকরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে অর্থ, ব্যক্তিগত তথ্য বা অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বে এই অনলাইন প্রতারণা ক্রমেই একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই প্রতারণা থেকে বাঁচতে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা।
১. ফিশিং ইমেইল ও ভুয়া লিঙ্ক থেকে সতর্ক থাকুন
অনেক সময় প্রতারকরা ব্যাংক, জনপ্রিয় ওয়েবসাইট বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে ইমেইল পাঠায়। এসব ইমেইলে বলা হয়—“আপনার অ্যাকাউন্ট যাচাই করতে হবে” অথবা “আপনি পুরস্কার জিতেছেন।” ভেতরে দেওয়া লিঙ্কে ক্লিক করলেই আপনার তথ্য চলে যাবে প্রতারকের হাতে।
➡করণীয়:
- অপরিচিত ইমেইল বা এসএমএসে ক্লিক করবেন না।
- ওয়েবসাইটের ঠিকানা সবসময় ভালোভাবে চেক করুন—https:// দিয়ে শুরু হয়েছে কিনা।
- সন্দেহ হলে সরাসরি অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে গিয়ে লগইন করুন।
- ব্রাউজারে বুকমার্ক করা অফিসিয়াল লিঙ্ক ছাড়া অন্য লিঙ্ক ব্যবহার করবেন না।
২. সোশ্যাল মিডিয়া প্রতারণা
ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রামে প্রতারকরা সহজেই ফাঁদ পেতে রাখে। তারা কখনও ভুয়া অফার দেয়, কখনও লটারিতে জেতার প্রতিশ্রুতি দেয়, আবার অনেক সময় ভেরিফিকেশন বা পুরস্কারের নাম করে টাকা চায়।
➡করণীয়:
- অপরিচিত কারও পাঠানো লিঙ্কে যাবেন না।
- কাউকে নিজের ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র বা ব্যক্তিগত তথ্য দেবেন না।
- কোনো পুরস্কার জেতার দাবি এলে সেটি যাচাই না করে বিশ্বাস করবেন না।
- বন্ধুদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়ে গেলেও প্রতারকরা তাদের নাম ব্যবহার করতে পারে, তাই আগে সরাসরি ফোন করে নিশ্চিত হন।
৩. অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণা
ই-কমার্স ও ফেসবুক শপ এখন খুবই জনপ্রিয়। তবে এর সুযোগ নিয়ে অনেক ভুয়া পেজ বা ওয়েবসাইট গ্রাহকদের ঠকাচ্ছে। তারা কম দামে পণ্য দেখিয়ে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়।
➡করণীয়:
- সবসময় বিশ্বস্ত প্ল্যাটফর্ম থেকে পণ্য কিনুন।
- সম্ভব হলে ক্যাশ অন ডেলিভারি ব্যবহার করুন।
- ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজের রিভিউ দেখে নিন।
- অগ্রিম পুরো টাকা না দিয়ে আংশিক টাকা দিন বা কেবল ডেলিভারির সময় পরিশোধ করুন।
৪. ব্যাংক ও মোবাইল ফিন্যান্স প্রতারণা
প্রতারকরা অনেক সময় ফোন দিয়ে বলে—“আপনার বিকাশ/নগদ অ্যাকাউন্ট ব্লক হয়ে গেছে” অথবা “আপনি লোন অনুমোদন পেয়েছেন।” এভাবে তারা OTP, পিন কোড বা পাসওয়ার্ড চাইতে পারে।
➡করণীয়:
- ব্যাংক বা এমএফএস কখনো ফোনে OTP বা পিন চাইবে না।
- সন্দেহজনক কল এলে সঙ্গে সঙ্গে কেটে দিন।
- প্রয়োজনে অফিসিয়াল কাস্টমার কেয়ারে ফোন করুন।
- নিজের ব্যাংকিং তথ্য কারও সাথে শেয়ার করবেন না—even পরিবারের সদস্যদের সাথেও নয়।
৫. চাকরি ও বিনিয়োগের প্রতারণা
অল্প টাকায় বেশি লাভ, অথবা আগাম টাকা দিলে চাকরি নিশ্চিত—এসব প্রতারণা অনেক পুরনো কৌশল। বর্তমানে এগুলো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আরও বেড়েছে।
➡করণীয়:
- কোনো চাকরির জন্য টাকা দেবেন না।
- বিনিয়োগের আগে কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন ও অনুমোদন যাচাই করুন।
- “ডাবল টাকা ফেরত” বা অল্প সময়ে অতিরিক্ত লাভের প্রতিশ্রুতি এড়িয়ে চলুন।
৬. মোবাইল অ্যাপ ও সফটওয়্যার প্রতারণা
অপরিচিত বা ফ্রি সফটওয়্যারের মাধ্যমে অনেক সময় ডিভাইসে ভাইরাস বা স্পাইওয়্যার ঢুকে যায়। এগুলো গোপনে আপনার ছবি, তথ্য বা ব্যাংক ডেটা সংগ্রহ করে।
➡করণীয়:
- শুধুমাত্র অফিসিয়াল প্লে-স্টোর বা অ্যাপ-স্টোর থেকে অ্যাপ ডাউনলোড করুন।
- মোবাইলের অ্যাপ পারমিশন সবসময় চেক করুন।
- অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করুন এবং নিয়মিত আপডেট রাখুন।
৭. শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ও সুরক্ষা ব্যবস্থা
প্রতারকরা প্রায়ই দুর্বল পাসওয়ার্ড হ্যাক করে একাউন্টে প্রবেশ করে।
➡করণীয়:
- বড় হাতের অক্ষর, ছোট হাতের অক্ষর, সংখ্যা ও বিশেষ চিহ্ন মিলিয়ে পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন।
- প্রতিটি প্ল্যাটফর্মে আলাদা পাসওয়ার্ড রাখুন।
- দুই ধাপ যাচাইকরণ (2FA) চালু করুন।
- নিয়মিত পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করুন।
৮. শিশু ও পরিবারের নিরাপত্তা
শিশুরা অনলাইন গেম, ভিডিও বা চ্যাটে সহজেই প্রতারণার শিকার হতে পারে।
➡করণীয়:
- সন্তানদের ইন্টারনেট ব্যবহারে নজর দিন।
- প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সফটওয়্যার ব্যবহার করুন।
- শিশুদের শেখান যে অপরিচিত কারও সাথে ব্যক্তিগত তথ্য বা ছবি শেয়ার করা যাবে না।
৯. ভুয়া খবর ও প্রচারণা
প্রতারকরা অনেক সময় গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। যেমন—“এই লিঙ্কে ক্লিক করলে ফ্রি ইন্টারনেট পাবেন” বা “সরকারি অনুদান পাওয়া যাচ্ছে।”
➡করণীয়:
- তথ্য শেয়ার করার আগে সবসময় নির্ভরযোগ্য উৎস যাচাই করুন।
- ভুয়া ওয়েবসাইট ও গুজব এড়িয়ে চলুন।
- কোনো সন্দেহজনক খবর সরকারি বা প্রমাণিত সংবাদমাধ্যম থেকে মিলিয়ে নিন।
১০. আইনি সহায়তা নিন
প্রতারিত হলে নিরুৎসাহিত হয়ে বসে থাকবেন না। দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিন।
➡করণীয়:
- সাইবার ক্রাইম ইউনিট (CID বা পুলিশ সাইবার ক্রাইম বিভাগ)-এ অভিযোগ করুন।
- প্রতারণার প্রমাণ যেমন স্ক্রিনশট, মেসেজ বা লেনদেনের রসিদ সংরক্ষণ করুন।
- প্রয়োজনে স্থানীয় থানায় জিডি করুন।
উপসংহার
অনলাইনে প্রতারণা প্রতিদিন নতুন রূপে আমাদের সামনে আসছে। কারও কাছে এটি একটি ফোন কল, কারও কাছে একটি ইমেইল, আবার কারও কাছে একটি ভুয়া ওয়েবসাইট। তবে প্রতারণার ধরন যাই হোক না কেন, একমাত্র প্রতিরোধ হলো সচেতনতা।
মনে রাখবেন:
- অতিরিক্ত লোভে পড়লে ক্ষতি হবেই।
- ব্যক্তিগত তথ্যই আপনার সবচেয়ে বড় সম্পদ।
- যাচাই ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নেবেন না।
অনলাইনে নিরাপদ থাকতে নিজের পাশাপাশি পরিবারকেও সচেতন করুন। প্রযুক্তি আমাদের সুবিধার জন্য—এটিকে যেন প্রতারণার হাতিয়ার না বানানো হয়।